সুজন কুমার তঞ্চঙ্গ্যা, রাঙ্গামাটি জেলা প্রতিনিধিঃ জন্মের আগেই বাবাকে হারিয়েছেন, সেই মেয়েকে নিয়ে মা কালাসোনা চাকমা অনেক কষ্টে দিন যাপন করছেন, দুই ভাইয়ের দুইবোন ছোট বোন রুপনা, আর্থিক অভাবের কারনে ভাল স্কুলে পড়ার সুযোগ হয়নি তার, অভাবের সংসারে অনাহারে থেকেছেন অনেকদিন, অনেক সময়ে মায়ের সাথে রুপনা যোগ দিয়েছেন মায়ের সংগ্রামে। অবশেষে নানা ঘাত-প্রতিঘাত পেরিয়ে স্কুল শিক্ষকের সাহায্য ও অনুপ্ররনায় খেলাধুলা চালিয়ে যান।

রুপনার মা কালাসোনা চাকমা এই জীবন যুদ্ধের গল্প শুনাচ্ছিলেন আর কাদছেন প্রতিবেদকের সামনেই, রুপনার জন্মের আগেই তার বাবা মারা যান। ফলে জন্মের পর সবার কাছে পিতৃহারা সন্তান ছিল মেয়েটি।

বড় ভাই শান্তি জীবন বলেন,বাবা মারা যাওয়ার পর, মাকে আমাদের অনেক কষ্টে দুবেলা দুমুঠো ভাতের জন‍্য অনেক কষ্ট করতে হয়েছে, এখনো করছেন, আমার চোখে দেখা এমনো দিন গেছে সারাদিন আমার মা অন‍্যের বাড়িতে কাজ করেছে,এবং সেই বাড়ির দেওয়া ভাত নিজে না খেয়ে আমাদের খাইয়েছে, অভাবের সংসারে নিজে ও মাকে নিয়ে অনেক কষ্ট করে বোনকে নিয়ে দিন যাপন করেছে,ছোট বেলা থেকেই আমার বোনের খেলার প্রতি বেশি মনোযোগ ছিল, বলতে অনেক কষ্ট হচ্ছে সবার ছোট ও আদরের হলেও তার কোন আশা আমারা পূরন করতে পারিনি, পরিবারের মধ‍্যে আমার মা তাকে সবচেয়ে সাপোর্ট করেছেন, এলাকা থেকে এমনও শুনতে হয়েছে মেয়েরা কেন ফুটবল খেলবে,কেন বাহিরে যাবে,তার পরেও আমি ও আমার পরিবারের সবাই মনের দিক দিয়ে অনেক সাপোর্ট করেছি। সৃষ্টি কর্তা একদিন তাকাবে আমাদের।

বিকেএসপিতে থাকার সুবাদে আমার দেখা সে বছরে দুই একবার আসত বাড়িতে রুপনা।চাপা সভাবের হওয়ার ওর মনের ভিতর কিছু একটি কাজ করত,আমারা বুঝতে পেতাম,না পাওয়ার যন্ত্রণা বেশি কাজ করত,বন্ধুদের থেকে একদিন যেনেছিলাম সে ভাঙা ঘরে কিভাবে তার বন্ধুদের নিয়ে আসবে তাহলে সে লজ্জিত হবে। এসব কারনে খুব কুম আসত বেড়াতে, তাকে বাৎসরিক উৎসব গুলো ছাড়া আর দেখা যেত না। এসব লুকানো কষ্ট রয়েছে তার মনে গাথা।

সুবিলাশ চাকমা (ওয়ার্ড সদস‍্য) বলেন, রুপনা ও তার মায়ের বর্তমানে করুন অবস্থায় আছেন, শুধু মাত্র রাঙ্গামাটি ডিসি দেড় লাখ টাকা সাহায্য করেছেন, এছাড়া কোন প্রতিষ্ঠান সাহায্য করেনি, এমনি কি কোন বড় কোন কম্পানি, পাহাড়ে এই রকম অদম‍্য রুপনা, ঋতুপর্নার মত অসাধারণ খেলোয়ার ছড়িয়ে ছিটিয়ে রয়েছে, দরকার শুধু সহযোগিতা আর ভাল অনুশীলন এবং তদারকি। জেলা ক্রীড়া সংস্থা একটু নজর দিলেই হবে, এছাড়া রুপনার বাড়িতেও থাকার কোন উপায় নেই,ভাঙ্গা ঘরে যেন রুপনা নামের হীরের টুকরো মেয়ে ফুটবলার জন্মেছে।

এদিকে মা-মেয়ের স্থায়ী ঠিকানার জন‍্য একটি ঘর ও রাস্তা তৈরির ব‍্যবস্থা করবেন রাঙ্গামাটি জেলা প্রশাসন।

বড় ভাই শান্তি জীবন চাকমা আরো বলেন, তিনি দৈনিক কাজ করলে দুই দিন বসে থাকতেন। ছোট এক জরাজীর্ণ বাসায় থাকতে হচ্ছে ওদের, চার ভাই বোনের সংসার, দুই ভাই দুই বোন, ঠিকমতো চাল-ডাল নেই, এ নিয়ে প্রায় দিনই অনাহারে থাকতে হয়। রুপনা তেমন পরিবারের কোন সাপোর্ট পাইনি। পড়ার টেবিলে বসে রুপনা অনেক কেদেছে। চোখের জলে বইয়ের পাতা ভিজে গেছে কত দিন! খাবার দাবার সহ অনেক কিছুর, সৃষ্টিকর্তার কাছে শুধু প্রার্থনা করতেন আর রুপনা বলতেন মা আমাদের এমন একটা পরিবেশ দাও যেন একটু সুখে থাকতে পারি। জীবনে আর কিছুই চাই না।

স্কুলে পড়া আবস্থায় রুপনা:

স্কুলে পড়া অবস্থায় রুপনা খাবার, পোশাক-আশাক থেকে শুরু করে সব কিছু মাকেই জোগাড় করতে হতো। এছাড়া কিছুটা স্কুল শিক্ষক ও তার সহপাঠীরা সাহায্য করেছে।জীবনে কোনো দিন অপচয় করেছে বলে মনে পড়ে না। পড়াশোনার পাশাপাশি খেলাধুলার প্রতি সে অনেক মনোযোগী ছিল।

চোখের জল ফুরাত না রুপনার

রুপনা ও তার মায়ের রাতগুলোও খুব কষ্টের ছিল। বাবা হারা সংসারে এতিমের মত চলাফেরা করতে হত।বড় ভাই বলেন বোনকে দেখেছি রাতে ঘুমাতে যেত কাঁদতে কাঁদতে। সকালে উঠে কোনো মতে বুঝিয়ে রাখতে হত। এসবের মধ্যেও পড়া লেখার পাশাপাশি খেলাধুলা চালিয়ে যেতে উচ্ছাস যুগিয়েছে একমাত্র মা।

ভেবেছিলাম আর হবে না – মা (কালা সোনা চাকমা)

রুপনার মা কালা সোনা বলেন ,ভেবেছিলাম মেয়েকে আর পড়াশোনা করাতে পারবো না। এমন পরিস্থিতি কত সহ্য করা যায়? আগে তো বাঁচতে হবে। একদিন বইপত্র সব বস্তায় ঢুকিয়ে ফেলেছি। রুপনা আমাকে বুঝিয়েছে আমার শিক্ষক বীরসেন চাকমা অনেক ভালো,আমাকে অনেক সাহায্য করেন,ঘাগড়া বহুমুখী সরকারি প্রাথমিক বিদ‍্যালয়ে লেখা পড়াসহ থাকা খাওয়ার সু- ব‍্যবস্থা করেছেন।

কালাসোনা (মা)৷ তিনি আরো বলেন, এক পর্যায়ে শিক্ষক বীরসেন চাকমার তত্ত্বাবধায়নে থেকে লেখাপড়া ও খেলাধুলা অনুশীলন চালিয়ে গেছেন। বাচ্চাটারে নিয়ে অনেক কষ্ট করছি। কোনো মতে ডাইল-ভাত খাইয়া বাচ্চাটারে দাঁড় করাইছেন বীরসেন, মেলা জায়গায় কাজ করছি। বাবারে তোমারে কী কমু, বর্তমান পরিস্থিতি তো বেশি ভালা না। মাইয়া মানুষ কোন জায়গায় নিরাপদ? দিমু যে দুইডা টাকা, হেই সামর্থ্য আছিল না। আমার জীবনটা একটা কষ্টের সাগর। আমি তো কষ্ট পাইছি। রুপনাও প্রচুর কষ্ট পাইছে। আমাকে অনেক মানুষে সাহায্য করছে আমি মাইনসের ঋণ শোধ করতে পারুম না।

আমার কষ্ট হলেও দেশের মুখ উজ্জ্বল করেছে মেয়ে সেরা গোলকিপার হিসেবে,সে দেশের রত্ন,তাকে যেন সরকার অবহেলা না করে।