দেশে সম্প্রতি সবচেয়ে আলোচিত বিষয়ের একটি হচ্ছে ‘গুম’। বিষয়টি নিয়ে পক্ষে-বিপক্ষে নানা বিতর্ক থাকলেও এবার কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেত্রী মরিয়ম মান্নানের মা রহিমা বেগমের ‘নিখোঁজ’ হওয়া এবং তাকে খুঁজে পাওয়ার ঘটনায় গুমের অভিযোগ এবং বাস্তবতাকে আবারও প্রশ্নবিদ্ধ করে দিয়েছে।

রাজনৈতিক প্রতিপক্ষ একে অপরকে বিশেষ করে সরকারকে ঘায়েল করতে বিরোধী দলগুলো বিভিন্ন সময়ে বিভিন্ন ব্যক্তিকে গুম করার অভিযোগ সামনে এনেছে। দেশি-বিদেশি মানবাধিকার সংস্থাগুলোও কম যায় না, তারাও সুর মিলিয়েছে রাজনৈতিক অপচেষ্টায়! এ কারণে দেশে-বিদেশে সরকারকেও নানা সময়ে বিব্রতও হতে হয়েছে। কিন্তু এ ধরনের ঘটনায় রাষ্ট্রের চতুর্থ স্তম্ভ হিসেবে স্বীকৃত গণমাধ্যমগুলো কি সঠিক ভূমিকা রেখেছে? কোনো কোনো গণমাধ্যমের খবরের দিকে তাকালে অবশ্য তা মনে হয় না বলেই মতামত সিনিয়র গণমাধ্যমকর্মীদের।

দীর্ঘদিন থেকেই দেখা যাচ্ছে বিরোধী দলগুলো সরকারি দলকে আক্রমণকালে প্রধান অস্ত্র হিসেবে এই গুম-খুনকে ব্যবহার করে আসছে। এরসঙ্গে যুক্ত হয়েছে কয়েকটি গণমাধ্যম। যে কোনো কারণে যে কেউ কেবল নিখোঁজ হলেই হলো- যাচাই-বাছাই ছাড়াই সেটি গুমের ঘটনা বলে চালিয়ে দেয়ার চেষ্টা করেছে বিগত অন্তত ১০ বছর ধরে। কোনোরকম অনুসন্ধান এমনকি তথ্য-প্রমাণ ছাড়া এ ধরনের ঘটনাকে গুম বলে চালিয়ে দেয়ার চেষ্টা আর যাই হোক, গণমাধ্যমের কাজ নয়।

মরিয়ম মান্নানের মায়ের হারিয়ে যাওয়ার ঘটনায়ও ঢাক-ঢোল পিটিয়ে প্রচারণা কিন্তু তাকে খুঁজে পাওয়ার পর সেইসব গণমাধ্যমের চুপসে যাওয়া তাদের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্নের জন্ম দেয় বলে মনে করেন গণমাধ্যমে কর্মরত সিনিয়র সাংবাদিকরা।

আত্মগোপন যখন গুমের প্রচারণা

বিগত কয়েক বছরে যেসব ঘটনাকে গুম বলে প্রচার করা হয়েছে এমন কিছু ঘটনার দিকে তাকানো যেতে পারে। এরমধ্যে ২০১৪ বাংলাদেশ পরিবেশ আইনবিদ সমিতির (বেলা) প্রধান নির্বাহী সৈয়দা রিজওয়ানা হাসানের স্বামী ব্যবসায়ী আবু বকর সিদ্দিক, ২০১৫ সালে নাগরিক ঐক্যের আহ্বায়ক মাহমুদুর রহমান মান্না, একই বছরে বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন আহমেদ, ২০১৬ সালে বাংলাদেশ ব্যাংকের রিজার্ভ চুরির ঘটনার পর তথ্য ও যোগাযোগপ্রযুক্তি বিশেষজ্ঞ হিসেবে বিভিন্ন গণমাধ্যমে সাক্ষাৎকার দেয়া তানভীর আহমেদ, বিএনপি নেতা সালাউদ্দিন কাদের চৌধুরীর ছেলে হুম্মাম কাদের চৌধুরী, কুমিল্লা মেডিকেল কলেজ হাসপাতালের চিকিৎসক ইকবাল মাহমুদ, পাবনা মেডিকেল কলেজের শিক্ষার্থী তানভির আহমেদ, ব্যাডমিন্টন খেলোয়াড় রাকিবুল ইসলাম রকি, বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষক মোবাশ্বার হাসান, পুস্তক প্রকাশক তানভীর ইয়াসিন করিম, কল্যাণ পার্টির মহাসচিব আমিনুর রহমান, আইএফআইসি ব্যাংকের কর্মকর্তা শামীম আহমেদ, ব্যবসায়ী অনিরুদ্ধ রায় ইত্যাদি অনেক ব্যক্তিই নিখোঁজ হয়েছিলেন বলে জানা যায়। এসব ব্যক্তি আবার ফিরেও এসেছেন।

২০২১ সালে ইসলামী বক্তা আবু ত্ব হা মোহাম্মদ আদনান, মৎস্য খামারি ইমাম মাহাদী হাসান ডলারের নিখোঁজ এবং ফিরে আসার ঘটনা বেশ আলোচনা-সমালোচনার জন্ম দেয়। সর্বশেষ কোটা সংস্কার আন্দোলনের নেত্রী মরিয়ম মান্নানের মা ফিরে আসার ঘটনাটি সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমসহ বিভিন্ন মাধ্যমে তুমুল আলোচিত হচ্ছে।

‘রহস্যজনকভাবে নিখোঁজ’ হওয়ার পর এভাবে পরিবারের কাছে ফিরে এসেছেন অনেকেই। কিন্তু দেখা যায়, যারা স্বেচ্ছায় হারিয়ে বা আত্মগোপনে গিয়েছিলেন, কিছুদিন পর তাদের খুঁজে বের করেছে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী, সেই বিষয়ে কিছু গণমাধ্যম একদম নিশ্চুপ থাকে; কিছুদিন আগেই যারা এ ধরনের রহস্যময় অন্তর্ধানের প্রতিটি ঘটনাকে গুম হিসেবে ব্যাপক প্রচার-প্রচারণায় নেমেছিল। সর্বশেষ মরিয়ম মান্নানের মা রহিমা বেগমের ঘটনাটিও বিষয়টি আবারও নতুন করে সামনে এনেছে।

কেন এত আলোচনা, কে এই মরিয়ম মান্নান

গত ২৭ আগস্ট রাত সাড়ে ১০টার দিকে খুলনার দৌলতপুরের মহেশ্বরপাশার বণিকপাড়া থেকে রহিমা নিখোঁজ হন বলে অভিযোগ করে তার পরিবার। এরপর থেকে কয়েক দিন ধরেই সামাজিক যোগাযোগমাধ্যম ফেসবুকে হইচই মরিয়ম মান্নানের মায়ের ‘নিখোঁজ’ হওয়া নিয়ে। নিজের ফেসবুক আইডি থেকে মরিয়ম নিজেই দিয়ে আসছিলেন নানা আপডেট। পাশাপাশি চলছিল পোস্টারিং, সংবাদ সম্মেলন ইত্যাদি।

গত ২২ সেপ্টেম্বর ময়মনসিংহে উদ্ধার হওয়া এক নারীর মরদেহকে রহিমা বেগমের বলে দাবি করেন তার মেয়েরা। ওইদিন রাত পৌনে ১২টায় মরিয়ম মান্নান ফেসবুক এক পোস্টে বলেন, ‘আমার মায়ের লাশ পেয়েছি আমি এইমাত্র।’ বিষয়টি নিয়ে ব্যাপক চাপের মুখে পড়ে আইনশৃঙ্খলা বাহিনী।

কিন্তু ঘটনা পাল্টে যায় যখন কথিত নিখোঁজের ২৯ দিন পর গত শনিবার (২৪ সেপ্টেম্বর) রাত পৌনে ১১টায় রহিমাকে ফরিদপুর থেকে অক্ষত অবস্থায় উদ্ধার করা হয়, সামনে আসে প্রকৃত ঘটনা।

পুলিশের ভাষ্য, জমিসংক্রান্ত বিরোধে প্রতিপক্ষকে ফাঁসাতে মা-মেয়েরা এ ঘটনা ঘটিয়েছেন। রহিমা আত্মগোপনে যাওয়ার পর অজ্ঞাতপরিচয় যেকোনো নারীর মরদেহকে মায়ের বলে দাবি করার পরিকল্পনাও সাজিয়ে রেখেছিলেন তার মেয়েরা।

বিষয়টি নিয়ে বিভিন্ন গণমাধ্যমে খবর প্রকাশিত হলে দেশজুড়ে ব্যাপক নেতিবাচক প্রতিক্রিয়া সৃষ্টি হয়। সামাজিক যোগাযোগ মাধ্যমে মরিয়ম মান্নানের ব্যাপক সমালোচনা করে অনেকেই তার ঘটনাটিকে ‘থ্রিলার ওয়েব সিরিজ’ বা ‘শ্রেষ্ঠ বাংলা সিনেমা’ হিসেবে অভিহিত করেন। আর এতেই ক্ষেপে যান মরিয়ম মান্নান, সাংবাদিক ও নেতিবাচক মন্তব্য করা ব্যক্তিদের আক্রমণ করে ফেসবুকে স্ট্যাটাস দেন তিনি।

স্ট্যাটাসে মরিয়ম মান্নান লিখেছেন, ‘দালাল সাংবাদিকরা যে যা দিল সব বিশ্বাস করে নিলেন এত সহজে? আর আমি আমার মায়ের জন্য এত সংগ্রাম করেছি, এত চোখের জল পড়েছে, সেটার কী দাম নেই?

গণমাধ্যমে প্রকাশিত খবর থেকে জানা যায়, নিজের মাকে নিখোঁজ দেখিয়ে তুঘলকিকাণ্ড ঘটানোর আগে ২০১৮ সালেও আলোচনার জন্ম দিয়েছিলেন তেজগাঁও কলেজের শিক্ষার্থী এই মরিয়ম মান্নান।

সে বছর কোটা সংস্কার আন্দোলনে পুলিশি হেফাজতে নির্যাতনের অভিযোগ তুলেছিলেন তিনি। বিষয়টি দেশব্যাপী তীব্র আলোচনা-সমালোচনার সৃষ্টি করে। যদিও তদন্তে সেই অভিযোগের কোনো সত্যতা পায়নি পুলিশ। এবার মাকে জড়িয়ে সম্প্রতি ঘটনাটিও সারা দেশে সৃষ্টি করেছে রহস্যের ধূম্রজাল।

কেন এই রহস্যময় অর্ন্তধান

গত আগস্ট মাসে জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাই কমিশনার মিচেল ব্যাচেলেট বাংলাদেশ সফর করেছেন। সে সময় বাংলাদেশ সরকারের দায়িত্বশীলদের কাছে গুমের অভিযোগের বিষয়ে জানতে চান।

এ বিষয়ে আইনমন্ত্রী আনিসুল হক গণমাধ্যমকে জানান, সরকার জাতিসংঘের মানবাধিকার কমিশনারকে জানিয়েছে, বাংলাদেশে তিন কারণে মানুষ ‘নিখোঁজ’ হয়। প্রথমত, রাষ্ট্রের বিরুদ্ধে অপরাধে জড়িত হওয়ার পর শাস্তি থেকে বাঁচার জন্য। দ্বিতীয়ত, কেউ ব্যবসায় লোকসান করলে। তৃতীয়ত, পারিবারিক কারণে।

গুম ও বিচারবহির্ভূত হত্যাকাণ্ড নিয়ে যখন বিরোধী দল এবং মানবাধিকার সংস্থাগুলো সরকারকে তুলোধুনো করতে ব্যস্ত গত ২৫ আগস্ট তখনই মিশেল ব্যাচেলেটের রিপোর্ট প্রকাশিত হয়, যেখানে জাতিসংঘের দৃষ্টিতে মানবাধিকার বা অন্যান্য বিষয়ে বাংলাদেশ সম্পর্কে কোনো উদ্বেগ প্রকাশিত হয়নি। যা গুমের প্রচারণাকারীদের মুখে ‘ছাই’ পড়ার শামিল। এ ছাড়া মরিয়ম মান্নানের মায়ের ঘটনাটি পারিবারিক কারণেই ঘটেছে বলে স্পষ্টভাবে প্রতীয়মান হয়।

গণমাধ্যমগুলো কেন এমন করে, কী বলছেন সংশ্লিষ্টরা

দেশে বিভিন্ন সময়ে হারিয়ে যাওয়া এবং ফিরে আসার তালিকা বেশ দীর্ঘ। কিন্তু প্রতি ক্ষেত্রেই দেখা যায় কয়েকটি রাজনৈতিক দল, মানবাধিকার সংস্থা এবং কয়েকটি গণমাধ্যম বেশ হৈ চৈ শুরু করে; যার অন্যতম লক্ষ্যবস্তু হয়েছে সরকার।

এ বিষয়ে সিনিয়র গণমাধ্যম কর্মীদের ভাষ্য, রাজনৈতিক দল এবং মানবাধিকার সংস্থাগুলো এমনটা করতে পারে কেননা, তাদের রাজনৈতিক এজেন্ডা থাকে। কিন্তু এ ধরনের প্রচার-প্রচারণায় গণমাধ্যমের শামিল হওয়াটা দুঃখজনক।

ঢাকা রির্পোটার্স ইউনিটির সভাপতি নুরুল ইসলাম মিঠু মনে করেন, কোনো ঘটনা খতিয়ে না দেখে গুম বলে প্রচার করা কোনো গণমাধ্যমের পেশাদার আচরণ নয়।

তিনি বলেন, গণমাধ্যম হিসেবে প্রতিষ্ঠানগুলোর দায় রয়েছে প্রকৃত ঘটনা কী সেটি খতিয়ে দেখা এবং তা জনসম্মুখে প্রকাশ করা। যখন কেউ ‘গুম’ হয়েছে বলে প্রচার করা হয় তখন সেটি খুব সাবধানতা অবলম্বন করা উচিত। কেননা এসব প্রচারণা খুব বেশি স্পর্শকাতর।

মরিয়ম মান্নানের মা রহিমা বেগমের প্রসঙ্গ টেনে তিনি বলেন, ওই নারী নিখোঁজ হওয়ার খবরটি বিভিন্ন গণমাধ্যমে অত্যন্ত গুরুত্ব দিয়ে প্রচার করা হয়েছে। কিন্তু তাকে যখন পাওয়া গেল আমরা শুধু পুলিশের বক্তব্য শুনলাম। কিন্তু রহিমা বেগম এতদিন কোন বাড়িতে ছিলেন, কেন ছিলেন, সত্যিই তিনি গুম হয়েছিলেন কিনা, যদি তিনি সে বাড়িতে আশ্রয় নিয়ে থাকেন তবে কেন সেখানে আশ্রয় নিয়েছিলেন, কোনো ভয়ভীতি ছিল কি না— ইত্যাদি কোনো ধরনের তদন্ত প্রতিবেদন গণমাধ্যমে দেখা যাচ্ছে না।

গুমের খবর প্রচারণা গুরুত্ব পায়, কিন্তু কেউ যখন ফিরে আসে সেটি গণমাধ্যমে গুরুত্ব না পাওয়ার বিষয়ে তিনি বলেন, গুমের খবর প্রচারের পর কেউ যখন ফিরে আসে আর সেটি যখন সুকৌশলে এড়িয়ে যায় কোনো গণমাধ্যম, তখনই বিগত দিনে নিখোঁজের খবর ছড়ানো এবং তাদের উদ্দেশ্য নিয়ে প্রশ্নের সৃষ্টি হয়।

এসব বিষয়ে গণমাধ্যমকে হিসেবে আরও নিরপেক্ষ ও দায়িত্বশীল হওয়া উচিত বলেও মন্তব্য করেন তিনি।

অপরদিকে জ্যেষ্ঠ সাংবাদিক কুদ্দুস আফ্রাদ গণমাধ্যমের এমন আচরণের পেছনে সংবাদপত্রের সরকার বিরোধী নেতিবাচক মানসিকতা, অনুসন্ধান ছাড়াই খবর প্রকাশ এবং পাঠকের নেতিবাচক চাহিদাকে লক্ষ্য করে খবর প্রকাশকে দায়ী করেছেন।

তিনি বলেন, গণমাধ্যম যদি বিশেষ কোনো এজেন্ডাকে সামনে নিয়ে খবর প্রকাশ করে সেটি অবশ্যই নেতিবাচক ও হতাশাজনক। এ ধরনের আচরণ দায়িত্বশীল কোনো গণমাধ্যমের কাছে কাম্য নয়।

যারা এ ধরনের খবর প্রচার করে তারা বিশেষ উদ্দেশ্য নিয়েই করে থাকে বলে মন্তব্য করেন তিনি।

কুদ্দুস আফ্রাদ আরও বলেন, আপনি খেয়াল করে দেখুন জাতিসংঘের মানবাধিকার বিষয়ক হাই কমিশনার মিচেল ব্যাচেলেট যখন বাংলাদেশ সফর করলেন তার কিছুদিন আগে থেকেই হঠাৎ কোনো কোনো গণমাধ্যমে নিখোঁজ বা গুম নিয়ে সংবাদ প্রকাশের হিড়িক পড়ে গেল। এটিকে পরিকল্পিত বলেই মনে হয়েছে আমার। এ ধরনের কর্মকাণ্ডের পেছনে নিশ্চয় কোনো ইন্ধন রয়েছে।