হঠাৎ চারদিক আলোয় আলো হয়ে গেল। ভগ্নস্তুপ থেকে উঠে এসেছে সেই আগের জমিদারবাড়ি। আমরা চারজন পাথর হয়ে বসে রইলাম। মুষলধারায় বৃষ্টি আর গাছপালার উন্মত্ত দাপাদাপির মধ্যে মনে হতে লাগল আজই হয়ত অতিথিশালার ছাদ ভেঙে আমরাও হারিয়ে যাব চিরকালের মতো। কিন্তু ভয় পেলে চলবে না। জানতেই হবে মামা কোথায় গেলেন।

অতিথিশালার কাছেই ঘোড়ার ক্ষুরের আওয়াজ শোনা গেল। একটু পরেই অতিথিশালার গা ঘেঁষে বেরিয়ে গেল একটা ঘোড়ার গাড়ি। ঘোড়ার গাড়িটা যেন জমিদারবাড়ির আলোর বন্যার ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। সাদা ঘোড়া দুটোকে মূহুর্তের জন্য স্পষ্ট দেখা গেল। জীবন্ত জমিদারবাড়ির কোনও আওয়াজ আমাদের কানে আসছে না; শুধু দেখতে পাচ্ছি বাড়ির মধ্যে অসংখ্য ছায়ামূর্তি চলেফিরে বেড়াচ্ছে। ঝড়বৃষ্টি থেমে গেছে; আমাদের চারপাশের অন্ধকার আরও গাঢ় হয়েছে। থমথমে পরিবেশে একটা প্যাঁচা কর্কশ চিৎকার করতে করতে আমাদের অতিথিশালার মাথার ওপর দিয়ে উড়ে গেল। আপ্রাণ চেষ্টা করে নিজেদের মনে সাহস এনে আমরা বসে রইলাম ভোরের অপেক্ষায়।
ঊষার আলো ফুটতেই আমরা স্বস্তির নিশ্বাস ফেললাম। গাছে গাছে পাখি ডেকে উঠল। অস্পষ্ট পাহাড়ের মতো দাঁড়িয়ে আছে পোড়ো জমিদারবাড়ি। কোথায় বা সেই আলোর রোশনাই, কোথায় মানুষজন, কোথায়ই বা সেই সাদা ঘোড়ায় টানা গাড়ি। প্রাণের চিহ্নমাত্র নেই কোথাও। অতিথিশালা থেকে বেরিয়েই চমকে উঠলাম, ভিজে মাটিতে ঘোড়ার ক্ষুরের আর গাড়ির চাকার দাগ স্পষ্ট।
ফিরে এলাম মহেশের বাড়িতে। দাদুকে বললাম, রাতে যা যা দেখেছি। ঠিক হল, সেই দিনটা বিশ্রাম নিয়ে পরদিন রাতে আবার আমরা যাব। এবার আরও কয়েকজনকে সঙ্গে নেবার পরামর্শ দিলেন দাদু। তাদের হাতে থাকবে মশাল, প্রয়োজনবোধে জ্বালাবে। এরা থাকবে অতিথিশালায় আর আমরা চারজন থাকব জমিদারবাড়ির গা ঘেঁষে দাঁড়িয়ে থাকা পুরনো বটগাছটায়। মহেশ আসবার সময় গাছটা দেখে নিয়েছে। দাদু বললেন, ” গ্রামের লোকজনকে নিয়ে আমি তৈরিই থাকব; মশালের আলো দেখলেই গ্রামের লোকদের নিয়ে আমি এসে পৌঁছবো। “
সন্ধ্যের আগেই বেরিয়ে পড়লাম। আমাদের সঙ্গে গ্রামের আরও চারজন লোক যোগ দিয়েছে। তাই ব্যাপারটাকে চ্যালেঞ্জ হিসেবে নিয়ে আমরা এগিয়ে চললাম মাঠের ওপর দিয়ে। জমিদারবাড়ির অতিথিশালায় এসে গ্রামের চারজনকে সেখানে রেখে আমি, শিবু, বসন্ত আর মহেশ একে একে উঠে পড়লাম বটগাছটায়। মহেশের নির্দেশমতো আমরা গাছের ডালের সঙ্গে দড়ি দিয়ে নিজেদের বেঁধে রাখলাম, যাতে আচমকা পড়ে না যাই। ঝড়বৃষ্টি আজ আর নাই; কিন্তু ঠান্ডাটা যেন আজ একটু বেড়েছে। চুপচাপ বসে আছি, কারোর মুখে কোনও কথা নেই। একটা অজানা আশঙ্কায় সকলেই সজাগ।
রাত যত বাড়ে, আমাদেরও অস্বস্তি বাড়ে। খালি মনে হচ্ছে কারা যেন আমাদের চারপাশে ঘুরে বেড়াচ্ছে। তাদের অদৃশ্য উপস্থিতি প্রতি মূহুর্তে অনুভব করছি। আগের রাতের মতো পেটা ঘড়িতে একটা বাজতেই জ্বলে উঠল জমিদারবাড়ির সব আলো। কানে এল ঘোড়ার চিঁ….হিঁ…হিঁ ডাক। দুটো ঘোড়া এদিকে ছুটে আসছে। কিছুক্ষণের মধ্যেই আমাদের বটগাছের তলা দিয়ে ঘোড়ায় টানা সুন্দর গাড়িটা বাড়ির ভেতর ঢুকে গেল। বটগাছের ওপর থেকে আমরা বাড়ির ভেতরটা আর সামনের ঘরগুলো দেখতে পাচ্ছিলাম। দেখলাম, গাড়িটা গিয়ে উঠোনে দাঁড়াল; চালক গাড়ির ওপর বসে। বাড়ির ভেতর থেকে ভেসে আসছে গান বাজনার আওয়াজ, লোকজনের টুকরো টুকরো কথাবার্তা। আচমকা সব শব্দ ছাপিয়ে কেউ যেন জোরে কেঁদে উঠল। চমকে উঠলাম আমরা চারজন। এ তো জ্যান্ত মানুষের আর্তনাদ। পরমূহুর্তে নিস্তব্ধ রাতের সমস্ত স্তব্ধতাকে চুরমার করে দিয়ে ঘোড়ার গাড়িটা উল্কার বেগে কোথায় চলে গেল। আবার কিছুক্ষণ পর ফিরে এসে আগের জায়গায় স্থির হয়ে দাঁড়িয়ে গেল।
পরিষ্কার দেখলাম, গাড়ির ভেতর থেকে একটা বীভৎস মুখ বেরিয়ে এসে ঢুকে গেল বাড়ির ভেতরে। আবার কান্নার আওয়াজ আর আর্তনাদ ছড়িয়ে পড়ল চারদিকে। এখানকার বাতাস যেন ক্রমেই ভারী হয়ে উঠছে, আমি আস্তে করে বসন্ত, শিবু আর মহেশকে বললাম, ” সাবধানে থাকো। “
সামনের যে জানলাটা দিয়ে ভেতরটা দেখা যাচ্ছিল, হঠাৎ দেখলাম সেই জানলায় একটা মূর্তি এসে দাঁড়িয়েছে। আলো অন্ধকারে তার মুখটা দেখতে পাচ্ছিলাম না। কিন্তু জানলার কাছ থেকে সরে গিয়ে যখন ঝাড়লন্ঠনের তলায় গিয়ে সেটা দাঁড়াল, তখন তার বীভৎস কালো আর পোড়া মুখটা দেখে আমরা চারজনেই আঁৎকে উঠলাম। এরকম বীভৎস মুখ আর চেহারা আগে কখনো দেখিনি। এরপর ঘরের মধ্যে প্রবেশ করল আরও কয়েকটা মূর্তি। প্রত্যেকের দেহ যেন আগুনে ঝলসানো, মুখগুলো পুড়ে ভয়ঙ্কর হয়ে গেছে। তারা লম্বা লম্বা হাত দিয়ে ঘরে দাঁড়ানো মূর্তিটাকে জোর করে একটা বিশাল খাটে শুইয়ে দিয়ে তার ওপর চাপিয়ে দিল কয়েকটা পুড়ে যাওয়া বিছানার চাদর। খাটে শুয়ে থাকা মূর্তিটা ছটফট করে হাত পা ছুঁড়তে লাগল। তার পুড়ে খাক হয়ে যাওয়া সাদা সাদা হাত পা দেখে ঐ শীতের মধ্যেও আমি ঘামতে শুরু করলাম। বাকি তিনজনের অবস্থাও তথৈবচ। একে অপরকে আঁকড়ে ধরে ঠকঠক করে কাঁপছি। ঘরের প্রত্যেকটা মূর্তির চেহারা তখন একই ধরনের। তারপর আমাদের
সমস্ত চিন্তা ভাবনাকে চুরচুর করে দিয়ে বীভৎস মূর্তিগুলো হাত পা নেড়ে নিজেদের মধ্যে কিসব বলাবলি করতে লাগল। আমরা কিচ্ছু বুঝতে পারছিলাম না। ভয়াবহ এই অভিজ্ঞতার মুখোমুখি হয়ে আমরা যখন দিশেহারা, তখন এমন একটা ব্যাপার ঘটল যে আতঙ্কে আমরা একে অন্যকে জাপটে ধরলাম। গাছের সঙ্গে দড়ি দিয়ে বাঁধা না থাকলে বোধহয় আমরা পড়েই যেতাম। ঘরের প্রত্যেকটা মূর্তিই কঙ্কাল হয়ে গেছে।
এতগুলো কঙ্কালকে একসাথে দেখে বসন্ত ভয়ে অজ্ঞান হয়ে গেল। পিঠে বাঁধা জলের বোতল থেকে ওর মুখেচোখে জল ছিটিয়ে কোনওরকমে ওকে সুস্থ করলাম। ঠিক তখনিই কয়েকটা মাংসহীন হাত এদিকে এগিয়ে এসে আমাদের বটগাছটাকে ধাক্কা মারতে লাগল। ভাগ্যিস গাছের সঙ্গে নিজেদের বেঁধে রেখেছিলাম। বুঝতে পারলাম, আমাদের উপস্থিতি ওরা টের পেয়ে গেছে।
তারপর কি হয়েছিল, আমরা জানি না।
যখন জ্ঞান হল দেখলাম, আমি জমিদারবাড়ির সামনের মাঠে শুয়ে আছি। আমাকে ঘিরে অনেক লোক। পরে শুনেছিলাম, আমাদের সকলের চিৎকার শুনে অতিথিশালা থেকে আমাদের সঙ্গে আসা ঐ চারজন জ্বলন্ত মশাল হাতে বেরিয়ে এসে আমাদের উদ্ধার করে। ওদিকে, মশালের আলো দেখে মহেশের দাদুও গ্রামের শ’ দুয়েক লোককে নিয়ে এখানে এসে পড়েন। পরে গ্রামের লোক জমিদারবাড়ি ঘিরে ফেলে বাড়ির ভেতর থেকে চার পাঁচজন লোককে উদ্ধার করে, যাদের মধ্যে আমার মামাও আছেন। তবে উদ্ধারকারীরা ঐসব ভৌতিক ব্যাপার স্যাপার কিছুই দেখতে পায়নি। যাদের উদ্ধার করারা হয়েছে, তাঁরা সকলেই মামার মতো ডাক্তার। নিশুতি রাতে রোগীর বাড়ি থেকে ডাক পেয়ে ছুটে এসেছিলেন জমিদার বাড়িতে।
সেদিন মহেশের দাদু, মহেশ আর গ্রামের লোকজন আমাদের জন্য যা করেছিলেন, তার তুলনা নেই। সকলকে ধন্যবাদ আর কৃতজ্ঞতা জানিয়ে আমরা মামাকে নিয়ে ফিরে এলাম রানীগঞ্জে। অনিদ্রায়, অনাহারে মামা তখন মানসিকভাবে সম্পূর্ন বিপর্যস্ত। কখনো ফ্যালফ্যাল করে সকলকে দেখছেন, কখনো চিৎকার করে কাঁদছেন। প্রায় উন্মাদ।
আমারও এদিকে স্কুলের ছুটি দ্রুত ফুরিয়ে আসছে। তাই বাধ্য হয়ে কলকাতা ফিরতে হল। মাঝে মাঝে বসন্তের চিঠি মামার দ্রুত আরোগ্যের খবর বয়ে আনে। স্বস্তি মনে হলেও, যখনিই সেই এক ঘর কঙ্কালের কথা মনে পড়ে, তখন এই কলকাতার বাড়িতে বসেও ঘেমে নেয়ে উঠি।
(সমাপ্ত)
———————-
আরিফুল ইসলাম