প্রতিনিধি -সাব্বির
নরসিংদী, ২২ জুন ২০২৫: নরসিংদীর পলাশ উপজেলার ডাঙ্গা ইউনিয়নের জয়নগর গ্রামে অবস্থিত শত বছরের পুরোনো লক্ষণ সাহার জমিদার বাড়ি আজও কালের সাক্ষী হয়ে দাঁড়িয়ে আছে। নিপুণ কারুকার্য আর স্থাপত্যশৈলীর এক অনন্য নিদর্শন এই বাড়িটি, যা স্থানীয়দের কাছে "উকিলের বাড়ি" নামেও পরিচিত। এক সময়ের জমজমাট জমিদারী ঐতিহ্যের প্রতীক এই প্রাসাদ, বর্তমানে তার পুরোনো জৌলুস হারিয়ে জীর্ণদশায় পরিণত হলেও, দেশের ইতিহাস ও ঐতিহ্যের এক গুরুত্বপূর্ণ অংশ হিসেবে টিকে আছে।
ইতিহাসের পাতা থেকে: ওয়াকফ সম্পত্তির জমিদারী
জানা যায়, জমিদার লক্ষণ সাহা এই জমিদার বংশের মূল গোড়াপত্তনকারী ছিলেন। তবে এই জমিদারী কবে নাগাদ প্রতিষ্ঠিত হয়েছিল, তার সঠিক তথ্য পাওয়া যায় না। লক্ষণ সাহা মূলত প্রধান জমিদারের অধীনে একজন সাব-জমিদার ছিলেন। তবে আশ্চর্যজনকভাবে, তাদের কখনো মূল জমিদার কিংবা ব্রিটিশ সরকারকে খাজনা দিতে হয়নি। কারণ, এই জমিদারী এলাকাটি ভারতীয় উপমহাদেশের একমাত্র ওয়াকফ হিসেবে চিহ্নিত ছিল।
লক্ষণ সাহার তিন পুত্র সন্তান ছিল – নিকুঞ্জ সাহা, পেরিমোহন সাহা ও বঙ্কু সাহা। ভারত ভাগের সময় বঙ্কু সাহা ভারতে চলে যান এবং ১৯৭১ সালের আগে নিকুঞ্জ সাহাও ভারত পাড়ি জমান। একমাত্র পেরিমোহন সাহাই এই বাড়িতে থেকে যান। পেরিমোহন সাহার একমাত্র ছেলে ছিলেন বৌদ্ধ নারায়ণ সাহা। পরবর্তীতে বৌদ্ধ নারায়ণ সাহা এই বাড়িটি স্থানীয় উকিল আহম্মদ আলীর কাছে বিক্রি করে দেন। আহম্মদ আলী সাহেব পেশায় উকিল হওয়ায় এই বাড়িটি "উকিলের বাড়ি" হিসেবে পরিচিতি লাভ করে।
স্থাপত্যের মুগ্ধতা ও বর্তমান অবস্থা
দ্বীতল বিশিষ্ট এই জমিদার বাড়িটি তৎকালীন স্থাপত্যশৈলীর এক উজ্জ্বল দৃষ্টান্ত। এর মেঝেতে কষ্টি পাথর দিয়ে ঢালাই করা হয়েছিল, যা এখনো বিদ্যমান। ছোট্ট একটি কারুকার্য খচিত দালান, বাগানবাড়ি, শান বাঁধানো পুকুর ঘাট এবং পুকুরের পাশে পূজা করার জন্য একসময় তিনটি মঠ বা মন্দির ছিল। যদিও বেশিরভাগ মঠ বর্তমানে ধ্বংস হয়ে গেছে, একটি এখনো টিকে আছে। বাড়ির চারপাশে উঁচু প্রাচীর দ্বারা ঘেরা একটি বিস্তৃত বাগানও রয়েছে। ২৪ কক্ষ বিশিষ্ট এই জমিদার বাড়ির কারুকাজ ও রঙের ব্যবহারে স্থানীয় শিল্পভাবনার সাথে ইউরোপীয় নকশার প্রভাব স্পষ্ট।
বর্তমানে, এই ঐতিহাসিক বাড়িটি অযত্ন ও অবহেলায় ধ্বংসের দ্বারপ্রান্তে। যদিও এর বর্তমান মালিকানা আহম্মদ আলীর নামে, তিনি নিজেও নারায়ণগঞ্জে বসবাস করেন। স্বাধীনতার পর জমিদার লক্ষণ সাহার নাতি বৌদ্ধ নারায়ণ সাহা এই দেবোত্তর সম্পত্তি বিক্রি করে দিলে স্থানীয় হিন্দু সম্প্রদায় "ট্রাস্ট" নামে একটি সংগঠন আদালতের শরণাপন্ন হয়। এই মামলার জটিলতা এবং সঠিক দেখভালের অভাবে বাড়িটি ধীরে ধীরে তার জৌলুস হারাচ্ছে।
পর্যটন সম্ভাবনা ও সংরক্ষণের দাবি
নরসিংদীর এই ঐতিহাসিক জমিদার বাড়িটি প্রতিদিন দূর-দূরান্ত থেকে বহু পর্যটকদের আকর্ষণ করে। এর ঐতিহাসিক গুরুত্ব এবং স্থাপত্যিক সৌন্দর্য একে একটি আকর্ষণীয় পর্যটন কেন্দ্রে পরিণত করার অপার সম্ভাবনা তৈরি করেছে। স্থানীয় জনসাধারণ এবং ইতিহাসপ্রেমীরা দীর্ঘদিন ধরে এই প্রাচীন জমিদার বাড়িটি সংরক্ষণ করে একটি পূর্ণাঙ্গ পর্যটন কেন্দ্র হিসেবে গড়ে তোলার দাবি জানিয়ে আসছেন। যথাযথ সরকারি উদ্যোগ এবং বেসরকারি সহযোগিতার মাধ্যমে এই ঐতিহাসিক নিদর্শনকে বাঁচানো সম্ভব, যা আমাদের ভবিষ্যৎ প্রজন্মের জন্য এক মূল্যবান সম্পদ হিসেবে বিবেচিত হবে।
নরসিংদী জেলা প্রশাসন এবং প্রত্নতত্ত্ব অধিদপ্তরের পক্ষ থেকে এই জমিদার বাড়ি সংরক্ষণে দ্রুত পদক্ষেপ নেওয়া হবে, এমনটাই আশা করছেন স্থানীয়রা। এটি শুধু একটি বাড়ি নয়, এটি বাংলাদেশের এক সমৃদ্ধ ইতিহাসের প্রতিচ্ছবি, যা সংরক্ষণ করা আমাদের সকলের নৈতিক দায়িত্ব।