নিজস্ব প্রতিবেদক, কুড়িগ্রাম:ব্রহ্মপুত্র নদ বেষ্টিত মাঝের আলগা দ্বীপচরের প্রান্তিক কৃষক আবদুল মমিন(৬৫)। এবছর তিনি দুই একর জায়গায় পাট চাষ করেছেন। কিন্তু শ্রাবণ মাসেও বৃষ্টিপাত না হওয়ায় পাট ‘জাক’ দেওয়া পানির অভাবে পাট কাটতে পারছেন না। অতিরিক্ত রোদে জমিতে পাট শুকিয়ে যাচ্ছে। একদিকে সঠিক সময়ে পাট কাটতে না পারা অন্যদিকে আমন চাষাবাদ ব্যাহত হওয়ায় আবদুল মমিনের মতো প্রান্তিক কৃষকরা দুশ্চিন্তায় পড়েছেন। জলবায়ু বিশেষজ্ঞ ও কৃষি কর্মকর্তারা সেচ ব্যবস্থার উন্নয়ন এবং জলবায়ু পরিবর্তনের উপযোগী ফসলের জাত চাষাবাদে দিকে নজর দিতে কৃষকদের পরামর্শ দিচ্ছেন।
বিগত এক দশকে জলবায়ু পরিবর্তনের কারণে কুড়িগ্রাম জেলার আবহাওয়া দ্রুত পরিবর্তিত হচ্ছে, যার প্রভাব পড়েছে কৃষি, স্বাস্থ্য এবং সাধারণ মানুষের জীবনযাত্রায়। গত কয়েক বছরে কুড়িগ্রামে গড় তাপমাত্রা ব্যাপকভাবে বেড়েছে, আর বৃষ্টিপাতের পরিমাণ নাটকীয়ভাবে কমে গেছে। বিশেষত, গ্রীষ্মকালে তীব্র তাপমাত্রা ও শ্রাবণ মাসেও বৃষ্টিহীনতা কৃষকসহ সাধারণ মানুষের জন্য এক কঠিন চ্যালেঞ্জ তৈরি করেছে।
আবদুল মমিনের বাড়ি কুড়িগ্রামের উলিপুর উপজেলার সাহেবের আলগা ইউনিয়নের মাঝের আলগার চরে। আবদুল মমিনের মতো জেলার নয় উপজেলার প্রান্তিক কৃষকরা বৃষ্টিপাতের অভাবে পাট ‘জাক’ দেওয়া নিয়ে দুশ্চিতায় আছেন। আবার কেউ কেউ আমন চাষাবাদ পিছিয়ে যাওয়ার শঙ্কায় ঘোড়ার গাড়িতে অতিরিক্ত ভাড়া দিয়ে পাট দূরের জলাশয়ে জাক দিচ্ছেন। এতে পাট চাষে লাভের চেয়ে লোকসানের ঝুঁকি বেশি দেখছেন তারা।
বাংলাদেশ আবহাওয়া অধিদপ্তর কুড়িগ্রামের রাজারহাট কেন্দ্রে ২০১৯ সাল থেকে জেলার তাপমাত্রা ও বৃষ্টিপাতের পরিসংখ্যান রয়েছে। ওই কেন্দ্র থেকে প্রাপ্ত তথ্যমতে, কুড়িগ্রাম জেলার গড় স্বাভাবিক তাপমাত্রা ৩২ ডিগ্রি থেকে ৩৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ২০১৯ সালে জেলার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা ছিল ৩২ দশমিক ৯ ডিগ্রি সেলসিয়াস। ২০২৫ সালের ২৯ জুলাই জেলার সর্বোচ্চ তাপমাত্রা রেকর্ড করা হয় ৩৮ দশমিক ২ ডিগ্রি সেলসিয়াস। সাত বছরের ব্যবধানে সর্বোচ্চ তাপমাত্রা বেড়েছে ৫ দশমিক ৩ ডিগ্রি সেলসিয়াস এবং গড় তাপমাত্রা ১ দশমিক ১ ডিগ্রি সেলসিয়াস বেড়েছে।
অন্যদিকে, জেলায় স্বাভাবিক বৃষ্টিপাত (জুলাই মাসে) ৪৫০ মিলিমিটার থেকে ৪৬০ মিলিমিটার। কিন্তু ২০২১ সাল থেকে ২০২৫ সালের জুলাই পর্যন্ত হিসাব করলে দেখা যায়, প্রতিবছর গড়ে ২১৩ মিলিমিটার করে বৃষ্টিপাত কমে গেছে। বিশেষ করে, গত কয়েক বছর ধরে শ্রাবণ মাসে বৃষ্টিপাত ছিল না বললেই চলে। এই শুষ্কতা কৃষকদের জন্য এক ভীষণ সমস্যার কারণ হয়ে দাঁড়িয়েছে।
আমন মৌসুমে কুড়িগ্রাম জেলার কৃষকরা চাষাবাদের জন্য বৃষ্টির উপর নির্ভরশীল থাকে। কিন্তু এখন তাদের সেচ ব্যবস্থার উপর বেশি নির্ভর করতে হচ্ছে। কয়েক বছরের ব্যবধানে গ্রীষ্মকালে তাপমাত্রার তীব্রতা ও বৃষ্টিপাতের পরিমাণ এমন পর্যায়ে পৌঁছেছে যে, কৃষকেরা চাষাবাদ নিয়েই সমস্যায় পড়েছেন। বিশেষ করে চরাঞ্চলের প্রান্তিক কৃষকরা বৈদ্যুতিক পাম্প সুবিধা না থাকায় সেচ নিয়ে দুশ্চিন্তায় পড়েছেন।
কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার ঘোগাদহ ইউনিয়নের কৃষক শফিকুল ইসলাম বলেন, ‘মাথার উপর ঠাডা(প্রচন্ড) পড়া রোদ। গরমে আমন চারা শুকিয়ে যাচ্ছে। যতই সেচ দেই, তবুও রোদে ফসল পুড়ে যাচ্ছে। বৃষ্টি কবে হবে, আল্লাহ জানে।’
মাঝের আলগার চরের আবদুল মমিন বলেন, ‘দুই একর জমিত পাট চাষা করছি। ফলনও ভালই হইছিল। আষাঢ় মাসে বন্যার সময় পাট কাটার কথা আছিল। কিন্তু আষাঢ় শেষে শ্রাবণ মাস হলেও বৃষ্টির দেখা নাই। পাট জাগ দেমো খাল-বিলে পানি নাই। বৃষ্টির অভাবে জমির পাট কাটতে পারছি না।’
তিনি আরও জানান, ‘বৃষ্টির অপেক্ষায় পাট কাটলে না পারলে আমন ধান চাষ করার সময় পাওয়া যাবে না। এজন্য কেউ কেউ পাট কেটে ঘোড়ার গাড়িতে করে দূরে নদীতে জাগ দিচ্ছে। এতে প্রতি আঁটি পাট ৫ টাকা করে খরচ যাচ্ছে। এভাবে খরচ বাড়তে থাকলে উৎপাদন খরচ উঠবে না।'
গবাদিপশু ও স্বাস্থ্য সংকট: অতিরিক্ত গরমে মহামারি
জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব প্রান্তিক খামারিদের অর্থনীতিতেও প্রভাব ফেলেছে। অতিরিক্ত তাপমাত্রায় খামারিরাও বিপদে পড়েছেন। বিশেষ করে গরমে ব্রয়লার মুরগির হিটস্ট্রোক মৃত্যুহার বেড়েছে। এছাড়াও, গবাদিপশু খামার ও প্রান্তিক চাষিদের গরুর মধ্যে লাম্পি স্কিন ডিজিজ ছড়িয়ে পড়েছে। ফলে চরাঞ্চলসহ জেলার প্রান্তিক গরুর খামারীরা গরু বিক্রি করে দিচ্ছেন।
উলিপুর উপজেলার আনন্দবাজার এলাকার মুরগি খামারি হালিমুর রশীদ বলেন, 'ব্রয়লার মুরগী ২ কেজি ওজনের বেশি করে বিক্রি করতে না পারলে লোকসানে পড়তে হয়। কিন্তু এবছর গরমের কারণে মুরগির ওজন ২ কেজি হওয়ার আগেই বিক্রি করে দিতে হচ্ছে। জুন মাসে খামারে ২ হাজার মুরগি তুলেছি। ২৫ দিন বয়স হওয়ার পর প্রায় প্রায় ৩০০ মুরগি হিটস্ট্রোকে মারা গেছে।'
কুড়িগ্রাম সদর উপজেলার হরিশ্বর তালুক এলাকার খামারি মেহেদী হাসান জানান, 'কয়েক বছর থেকে গরম আসলেই গরুর লাম্পি স্কিন রোগ দেখা দিচ্ছে। এতে গরু অসুস্থ হয়ে মারা যাওয়াসহ স্বাস্থ্যহানি ঘটছে। অতিরিক্ত গরম কৃষিকাজের মতো গবাদিপশু পালনও প্রভাব ফেলছে।’
কুড়িগ্রাম জেলা কৃষি সম্প্রসারণ অধিদপ্তরের উপপরিচালক মো. আবদুল্লাহ আল মামুন বলেন, গত বছর কুড়িগ্রামে ১৭ হাজার ২৬৫ হেক্টর জমিতে পাট চাষ হয়েছিল। এবছর কমে ১৬ হাজার ৫০ হেক্টর হয়েছে। জলবায়ু পরিবর্তনের ফলে প্রতিবছর পাট চাষ কমছে। সাধারণ জুন মাসের শেষে পাট কেটে ওই জমিতে আমন ধান রোপন করা হয়। কিন্তু খালবিলে পানি না থাকায় এখন পর্যন্ত ৬ হাজার ৫০০ হেক্টর পাট জমিতেই আছে। তাই আমন চাষ পিছিয়ে যাচ্ছে। এতে ফলন কম হবে।
এক প্রশ্নের জবাবে তিনি বলেন, পাট পচানোর জন্য উপযুক্ত পদ্ধতি হলো জাগ দেওয়া। তবে আধুনিক কৃষিব্যবস্থায় অনেক স্থানে আঁশকল মেশিনে পাট ছিলানো হচ্ছে। কিন্তু কুড়িগ্রামের প্রান্তিক কৃষকের জন্য এটি উপযুক্ত নয়। কারণ আঁশকলে ছিলানোর পর সেটা আবারও জাগ দিতে হয়। এছাড়াও আঁশকলে পাট ছিলানোর পর পাটসোলা নষ্ট হয়ে যায়। এতে প্রান্তিক কৃষকরা আর্থিকভাবে ক্ষতিগ্রস্ত হয়।
তিনি আরও বলেন, জলবায়ু পরিবর্তনের প্রভাব কৃষিতে এসে লেগেছে। এভাবে চলতে থাকলে কৃষি খাতের স্থায়িত্ব বিপন্ন হবে। তাই সেচ ব্যবস্থার উন্নয়ন এবং জলবায়ু পরিবর্তনের উপযোগী ফসলের জাত উদ্ভাবনের দিকে নজর দিতে হবে। সে পর্যন্ত কৃষককে একটু মানিয়ে নিয়ে চাষাবাদ করতে হবে বলেও এই কৃষিবিদ জানান।
জেলা প্রাণিসম্পদ কর্মকর্তা চিকিৎসক মো. হাবিবুর রহমান বলেন,
ব্রয়লার মুরগির জন্য সহনশীল তাপমাত্রা হলো ৩০ ডিগ্রি সেলসিয়াস থেকে ৪০ ডিগ্রি সেলসিয়াস। কিন্তু গত কয়েকবছরে কুড়িগ্রাম জেলায় তাপমাত্রা বৃদ্ধি পেয়ে কোন কোন মাসে ৪২ ডিগ্রি সেলসিয়াসের ওপরে উঠেছে। ওই সময়ে কিছু খামারের মুরগি হিটস্ট্রোকে মারা গেছে। অতিরিক্ত গরমে হিটস্ট্রোক থেকে খামারের মুরগি বাচাতে খামারিদের ছায়াযুক্ত, আলো বাতাস সহজে প্রবেশ করতে পারে এমন স্থানে খামার দিতে হবে। সেই সাথে খামারে ওয়াটার স্প্রে, ইলেক্ট্রোলাইট ব্যবহার এবং তাপমাত্রা সহনশীল জাতের ব্রয়লার মুরগির বাচ্ছা এখন বাজারে পাওয়া যাচ্ছে, সেগুলো দিয়ে খামার করার পরামর্শ দিচ্ছি।
অন্যদিকে গবাদিপশুর লাম্পিং রোগ মশা, মাছির মাধ্যমে ছড়ায়। আর গরম কালে মশা, মাছির উপদ্রুত একটু বেশিই থাকে। তাই কৃষকরা যদি অসুস্থ গরুকে আলাদা মশারি দিয়ে রাখে তবে এই রোগের পার্দুভাব কমে যাবে।