নিজস্ব প্রতিবেদক:- টাঙ্গাইলের মির্জাপুর উপজেলার আজগানা ইউনিয়নের ঘাগড়াই গ্রামে অবস্থিত আসলামের ইটভাটার পেছনে অবৈধভাবে কাঠ জ্বালিয়ে কয়লা উৎপাদন করা হচ্ছে। এই কার্যক্রম স্থানীয় মানুষের জীবন, স্বাস্থ্য এবং পরিবেশের জন্য মারাত্মক হুমকি সৃষ্টি করছে। স্থানীয়রা জানান, প্রতিদিনের কয়লা উৎপাদনের ধোঁয়া তাদের স্বাভাবিক জীবনযাত্রাকে ব্যাহত করছে এবং বনাঞ্চল ও জলবায়ুর ভারসাম্যকে বিপন্ন করছে।
সরেজমিনে গিয়ে দেখা গেছে, ইয়ার উদ্দিন সিকদারের ছেলে হাসেম সিকদার ও বিল্লাল মিলিতভাবে প্রতিদিন দুইটি অবৈধ কয়লার চুল্লি চালাচ্ছেন। এসব চুল্লিতে কাঠ জ্বালিয়ে কয়লা তৈরি করা হচ্ছে, যার ফলে বনাঞ্চলের বিভিন্ন প্রজাতির গাছ কাটা হচ্ছে। কাঁচামাল হিসেবে ব্যবহৃত হচ্ছে গজারি, গর্জন, সেগুন, আকাশমনি, পিকরাশিসহ মূল্যবান বনজ গাছ। এসব গাছের অনিয়মিত ও নির্বিচারে ছাঁটাই বনভূমির স্থিতিশীলতা নষ্ট করছে।
চুল্লি থেকে বের হওয়া কালো ধোঁয়া আশপাশের এলাকায় ছড়িয়ে পড়ে, যা মানুষের শ্বাসনালি, চোখ ও ত্বকের স্বাস্থ্যকে সরাসরি প্রভাবিত করছে। স্থানীয়রা অভিযোগ করেছেন, শিশু, বৃদ্ধ ও নারীদের মধ্যে শ্বাসকষ্ট, হাঁপানি, চোখে জ্বালা, ত্বকের বিভিন্ন রোগ এবং দীর্ঘমেয়াদে ফুসফুসের সমস্যার আশঙ্কা বেড়ে গেছে। বিশেষ করে শিশু ও বয়স্করা সবচেয়ে বেশি ঝুঁকিতে রয়েছেন। স্বাস্থ্য বিশেষজ্ঞরা সতর্ক করেছেন, দীর্ঘদিন এই ধরনের ধোঁয়া নিঃশ্বাসের মাধ্যমে শরীরে প্রবেশ করলে শ্বাসনালির সংক্রমণ, ফুসফুসের দীর্ঘমেয়াদী ক্ষতি এবং অ্যালার্জি সহ বিভিন্ন রোগের ঝুঁকি বেড়ে যায়।
অবৈধ কয়লা চুল্লি থেকে নির্গত ধোঁয়া এবং কাঁচামালের জন্য বনাঞ্চল উজাড় হওয়া পরিবেশের জন্যও মারাত্মক প্রভাব ফেলছে। মির্জাপুর উপজেলার প্রায় ১৫ হাজার ৮০০ হেক্টর সরকারি বন ভূমি রয়েছে। এই বনাঞ্চলে গজারি, গর্জন, সেগুন, আকাশমনি, পিকরাশিসহ বিভিন্ন মূল্যবান গাছের প্রজাতি রয়েছে, যা স্থানীয় জলবায়ু নিয়ন্ত্রণ, মাটি সুরক্ষা এবং বন্যপ্রাণীর বাসস্থানের জন্য অপরিহার্য। বনাঞ্চল উজাড় হলে মাটির ক্ষয়, বৃষ্টির জল শোষণ কমে যাওয়া এবং নদী ও খাল জলপ্রবাহে প্রভাব পড়ার আশঙ্কা থাকে।
এছাড়া, অবৈধ কয়লা চুল্লি স্থানীয় মানুষের জীবনযাত্রাকে ব্যাহত করছে। ধোঁয়ার কারণে শিক্ষাপ্রতিষ্ঠানগুলোর ছাত্রছাত্রীরা স্কুলে গিয়ে পড়াশোনা করতে অসুবিধা বোধ করছে। স্থানীয়রা বলছেন, ধোঁয়া বাতাসে ভরা থাকায় শিশুদের স্কুলে যাওয়া এবং খেলাধুলা করা কঠিন হয়ে গেছে। নারীরা রান্না করতে ও ঘরের কাজ করতে গিয়ে শ্বাসকষ্টের মুখে পড়ছেন, আর বৃদ্ধরা দীর্ঘমেয়াদী হাঁপানি ও অন্যান্য শ্বাসনালি সমস্যার সম্মুখীন হচ্ছেন।
এছাড়া, কয়লা উৎপাদনের অবৈধ এই কার্যক্রম স্থানীয় জীববৈচিত্র্যকেও হুমকির মুখে ফেলেছে। বনাঞ্চলে অনেক প্রজাতির পাখি, সাপ, ছিপা ও অন্যান্য প্রাণী বাস করে। বন উজাড় হওয়ায় তাদের অভ্যন্তরীণ বাসস্থান নষ্ট হচ্ছে, খাবারের অভাব তৈরি হচ্ছে এবং প্রাণীর সংখ্যা ক্রমেই কমছে। পরিবেশবিদরা সতর্ক করেছেন, দীর্ঘমেয়াদে বনাঞ্চলের এই ধরনের ক্ষতি পুরো ইকোসিস্টেমকে বিপন্ন করতে পারে।
স্থানীয়রা অভিযোগ করেছেন, প্রশাসনের অবহেলার কারণে কয়লা চুল্লি দীর্ঘদিন ধরে চলমান। “প্রশাসন যদি দ্রুত হস্তক্ষেপ না করে, তাহলে আমাদের জীবনের পরিবেশ ক্রমেই নষ্ট হয়ে যাবে,” জানিয়েছেন এক স্থানীয় যুবক। স্থানীয়রা আরও জানিয়েছেন, বনাঞ্চল ও আবাসিক এলাকা সংলগ্ন এই অবৈধ কার্যক্রম থেকে শুধু স্বাস্থ্য ঝুঁকি নয়, সামাজিক ও অর্থনৈতিক ক্ষতিও হচ্ছে। বনভূমি ও বনায়ন কর্মসূচী দীর্ঘমেয়াদে বনভূমি ও ফলজ গাছের মাধ্যমে স্থানীয় অর্থনীতিকে সমৃদ্ধ করতো, কিন্তু অবৈধ চুল্লি এই সুযোগকে বিনষ্ট করছে।
মির্জাপুর উপজেলা সহকারী কমিশনার (ভূমি) তারেক আজিজ গণমাধ্যমকে জানিয়েছেন, “আমি শীঘ্রই ঘটনাস্থলে যাচ্ছি। অবৈধ কয়লার চুল্লিগুলো বন্ধ করা হবে। বন বিভাগের সঙ্গে সমন্বয় করে এই চুল্লিগুলো বন্ধ করার ব্যবস্থা নেওয়া হবে।” প্রশাসনের দ্রুত পদক্ষেপই একমাত্র উপায় স্থানীয় মানুষ, বনভূমি এবং পরিবেশের ক্ষতি রোধ করার জন্য।
পরিবেশ বিশেষজ্ঞরা বলছেন, অবৈধ কয়লা চুল্লির কারণে বনাঞ্চল ধ্বংস, জলবায়ু পরিবর্তন, মাটি ক্ষয়, বন্যপ্রাণী ও জীববৈচিত্র্যের হ্রাস, বাতাস দূষণ এবং জনস্বাস্থ্যের ঝুঁকি তৈরি হচ্ছে। তারা সতর্ক করেছেন, এই সমস্যা দীর্ঘমেয়াদে যদি রোধ করা না হয়, তবে পুরো এলাকায় পরিবেশ ও জনজীবনের ভারসাম্য ভেঙে যাবে।
এলাকার সচেতন মহল অতি দ্রুত ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে অবৈধ কয়লা তৈরির কারখানা উচ্ছেদ করার জন্য ঢাকা বিভাগীয় কমিশনার, ঢাকা বিভাগীয় পরিবেশ অধিদপ্তর, টাঙ্গাইল জেলা প্রশাসক, জেলা পুলিশ সুপার, জেলা পরিবেশ অধিদপ্তর ও মির্জাপুর উপজেলা প্রশাসনের হস্তক্ষেপ কামনা করেছেন।