নিজস্ব প্রতিবেদক:- মাদারীপুর জেলার শিবচর উপজেলার দত্তপাড়া ইউনিয়নের বাবলাতলা বাজার কাইমুদ্দি শিকদারের কান্দী মোতাহার হোসেন মেম্বারের ইটভাটার পাশে পুরাতন ব্যাটারি আগুনে জ্বালিয়ে সিসা তৈরি করছে।
হুমকির মুখে প্রাকৃতিক পরিবেশ, জীব ও বৈচিত্র্য। কারখানার দূষিত কালো ধোঁয়ায় এলাকাবাসীর জীবন অতিষ্ঠ হয়ে উঠেছে।
সরেজমিনে গিয়ে কারখানাটিতে দেখা যায়, ২৮ থেকে ৩০ বছরের ১০/১৫ জন শ্রমিক কেউ ব্যাটারি থেকে প্লেট বের করছে, কেউ রাতে কাঠ–কয়লার আগুন জ্বালিয়ে সিসা তৈরি করার জন্য চুলার পাশে প্লেট সাজাচ্ছে।
এই কারখানাটির মালিক গাইবান্ধা জেলার সাঘাটা উপজেলার মোঃ জাহাঙ্গীর আলম।
এ ব্যাপারে স্থানীয় নাম প্রকাশে অনিচ্ছুক ১০/১২ জন লোক বলেন, প্রতিদিন রাত্রি ৮:০০ ঘটিকা হইতে ভোর ৫:০০ ঘটিকা পর্যন্ত যখন চুল্লিতে কাঠ–কয়লার আগুনে পুরাতন ব্যাটারির প্লেট জ্বালিয়ে সিসা তৈরি করে, তখন আশেপাশের এলাকায় বাড়ির ভেতরে থাকা লোকজনের কষ্টসাধ্য হয় ও নিঃশ্বাস বন্ধ হওয়ার উপক্রম হয়।
এই কারখানার ধোঁয়ার ফলে আশেপাশে দুই–তিন কিলোমিটার এলাকায় বাড়ির ভেতরে থাকা লোকজনের নাক–মুখ–চোখ জ্বালা করে, এলাকার শিশু ও বৃদ্ধরা শ্বাসকষ্টসহ বিভিন্ন রোগে প্রতিনিয়ত আক্রান্ত হচ্ছে।
আমরা এদের কাছে অসহায়, কখনো জোর করে কাউকে কিছু বলতে পারি না প্রাণভয়ে, কারণ এদের অনেক মাস্তান ভাড়াটিয়া সন্ত্রাসী বাহিনী আছে। যারা বিভিন্ন ভয় দেখায়, আমরা সাধারণ মানুষ সবসময় এদের কাছে জিম্মি ও অসহায়।
এলাকাবাসী জানান, কারখানাটির দূষিত ধোঁয়া ও এসিড পানির জন্য আশেপাশের মাঠের ফসল, গাছের ফল, নদীর মাছের ব্যাপক ক্ষতি সাধন হচ্ছে।
এলাকাবাসী আরও জানান, এই কারখানার আশপাশের জমি ও মাঠের ঘাস কেটে গবাদিপশুকেও খাওয়াতে পারছেন না পশুর মৃত্যুর ভয়ে। তারা আরও বলেন, এই কারখানার আশেপাশের মাঠের ঘাস খেলেই গরু মারা যাবে। এই ধোঁয়া ও ছাই বাতাসে উড়িয়ে যতো দূর গিয়ে পড়বে, সেই এলাকার ঘাস ও ধানের খড় খেলেই গরু মারা যাবে নিশ্চিত।
এরই সূত্র ধরে গুগলে সার্চ দিয়ে বিভিন্ন পত্রিকার নিউজ ও টেলিভিশন নিউজে জানা যায়—
২০২৩ সালে ব্রাহ্মণবাড়িয়ার সদর উপজেলার দাড়িয়াপুর এলাকায় অবৈধভাবে গড়ে ওঠা সিসা তৈরির কারখানায় ৩ মাসে ২৫টি গরু মারা গেছে।
সূত্রঃ দৈনিক প্রথম আলো।
২০২৩ সালে কিশোরগঞ্জের তাড়াইলে সিসা তৈরির কারখানার কারণে ৭ গরুর মৃত্যু।
সূত্রঃ সময়ের কণ্ঠস্বর।
২০২৩ সালে সিসা কারখানার নির্গত বিষাক্ত বর্জ্য খালে হবিগঞ্জের মাধবপুরে পানি খেয়ে ১২ গরুর মৃত্যু।
সূত্রঃ দৈনিক যুগান্তর।
২০২৩ সালে গোপালগঞ্জ জেলার কাশিয়ানী উপজেলার রাতইল সিসা তৈরি কারখানা এলাকার মাঠের ঘাস, লতা ও আঁখের পাতা খেয়ে ১২টি গরু মারা গেছে।
সূত্রঃ বাংলাভিশন টেলিভিশন।
২০২২ সালে ধামরাই সিসা তৈরি কারখানায় তিন মাসে ৮ গরুর মৃত্যু, অসুস্থ অর্ধশতাধিক।
সূত্রঃ দৈনিক জনবানী।
২০২২ সালে নরসিংদীর বেলাবতে পাঁচ দিনে হাফিজ অ্যাগ্রো কমপ্লেক্স নামের একটি খামারে একে একে পাঁচটি গরুর মৃত্যুর ঘটনা ঘটেছে।
সূত্রঃ দৈনিক প্রথম আলো।
২০২২ সালে কিশোরগঞ্জের কটিয়াদীতে সিসা তৈরি কারখানার পাশে দুটি গ্রামে ৩০টি গরুর মৃত্যু।
সূত্রঃ আজকের পত্রিকা।
২০২৪ সালের মার্চ মাসে ঝিনাইদহের হরিণাকুন্ডু উপজেলার চারাতলা নামক স্থানে অবৈধ সিসা কারখানার বিষক্রিয়ায় ১২টি গরুর মৃত্যু হয়েছে।
সূত্রঃ RTV।
২০২৪ সালের ডিসেম্বর মাসে বগুড়ার শাজাহানপুর উপজেলার বাবুরপুকুর এলাকায় অবৈধ সিসা তৈরির কারখানার পাশের জমির ঘাস খেয়ে ১ গরিব কৃষকের ২টি গরু মারা যায়। পরবর্তীতে এলাকাবাসীর অভিযোগে উপজেলা প্রশাসন ও পরিবেশ অধিদপ্তর বগুড়া অভিযান পরিচালনা করে অবৈধ সিসা তৈরির কারখানা উচ্ছেদ করে।
২০২৫ সালের জানুয়ারি বগুড়ার কাহালু উপজেলার বিএনপি নেতা আব্দুল মান্নানের ইটভাটায় অবৈধ সিসা তৈরির কারখানা উচ্ছেদ করেছে পরিবেশ অধিদপ্তর বগুড়া।
২০২৫ সালের অক্টোবর জামালপুর সদরে অবৈধ সিসা তৈরির কারখানার পাশের জমিতে এসিড বর্জ্য খেয়ে ১২ গরুর মৃত্যু।
২০২৫ সালের অক্টোবর মাসে রংপুরের বদরগঞ্জ উপজেলার কুতুবপুর ইউনিয়ন ও মিঠাপুকুর সীমান্ত ঘেঁষে বাদলের ঘাট এলাকায় চাঁপুল শাহের আমবাগানে চলছে ভয়াবহ পরিবেশবিনাশী পুরাতন ব্যাটারি আগুনে জ্বালিয়ে অবৈধ সিসা তৈরির কারখানার শতাধিক গরুর মৃত্যু।
গুগলে সার্চ দিয়ে জানা যায়, দেশের বিভিন্ন এলাকায় এমন আরও শতাধিক কারখানার কারণে গরু মারা গেছে এমন তথ্য মেলে। আরও জানা যায়, দেশের যে যে এলাকায় পুরাতন ব্যাটারি আগুনে জ্বালিয়ে সিসা তৈরির কারখানা করে, সেই এলাকার মাঠের ধান নষ্ট ও বিলের মাছের নিধন হয়েছে।
কারখানার শ্রমিকদের গণমাধ্যম কর্মীরা জিজ্ঞেস করলে—আপনারা এই কারখানায় কাজ করেন কিভাবে? এর তো প্রচুর গন্ধ, আইনশৃঙ্খলা বাহিনী আপনাদের কিছু বলে না?
শ্রমিকরা বলেন, এতে আমাদের শরীরের প্রচুর ক্ষতি হয়। থানা পুলিশ তেমন কিছু বলে না, কিন্তু উপজেলা প্রশাসন বা এসিল্যান্ড, পরিবেশ অধিদপ্তরের লোকজনকে কেউ জানালে তারা ভ্রাম্যমাণ আদালতের মাধ্যমে বন্ধ করে দেয়।
কারখানাটির মালিক গাইবান্ধা জেলার সাঘাটা উপজেলার মো. জাহাঙ্গীর আলমের নিকট পরিবেশ অধিদপ্তরের ছাড়পত্র আছে কিনা জানতে চাইলে গণমাধ্যম কর্মীদের বলেন, আমাদের কোনো কাগজপত্র নেই। সবাইকে ম্যানেজ করেই কারখানা চালাতে হয়।
আপনারা নিউজ করলে করেন, সমস্যা নাই। আমরা সবাইকে ম্যানেজ করেই চলি। নিউজ করলে পরিবেশ অধিদপ্তরের লোক, এসিল্যান্ড এনারাই তো আসবে। দেখা যাবে নিউজ করে কি করতে পারেন।
এলাকার সচেতন মহল অতি দ্রুত পুরাতন ব্যাটারি আগুনে জ্বালিয়ে সিসা তৈরির কারখানাটি ভ্রাম্যমাণ আদালত পরিচালনা করে উচ্ছেদ করার জন্য ঢাকা বিভাগীয় কমিশনার, ঢাকা বিভাগীয় পরিবেশ অধিদপ্তর, মাদারীপুর জেলা প্রশাসক, জেলা পুলিশ সুপার, মাদারীপুর জেলা পরিবেশ অধিদপ্তর ও শিবচর উপজেলা প্রশাসনসহ সংশ্লিষ্ট থানা পুলিশের সুদৃষ্টি কামনা করেন।